চাণক্য নীতি- যার উপদেশে চলত চন্দ্র গুপ্তের রাজ্য
মূলত ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ বইটির লেখক চানক্য। তার কিছু নিজস্য নীতি বা শিক্ষা ছিল যা আজও ব্যাপক সমাদৃত। তার প্রকৃত নাম নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চাণক্য, কৌটিল্য নাকি বিষ্ণুগুপ্ত? নানা নামের বিতর্ক হয়ে থাকে তাকে নিয়ে । ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ বইয়ের এক জায়গায় লেখককে বিষ্ণুগুপ্তও সম্বোধন করা হয়। তাছাড়া, চাণক্যই যে বিষ্ণুগুপ্ত, সে প্রমাণ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দের বিষ্ণু শর্মা নামক কোনো এক লেখকের ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামক একটি সংস্কৃত লেখায় পাওয়া যায়। চাণক্য এবং কৌটিল্য আলাদা ব্যক্তি তা খুব কমসংখ্যক ইতিহাসবিদই মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে চাণক্য ও কৌটিল্য একই ব্যক্তি হলেও বিষ্ণুগুপ্ত আলাদা মানুষ।
চাণক্যের ব্যক্তিগত জীবন – আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতের গোল্লা নামক অঞ্চলের চানাকা নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চাণক্য। তার পিতা চানিন এবং মাতা চানেশ্বরী ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাই চাণক্যও জন্মসূত্রেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। চাণক্যের বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই শৈশব থেকেই তিনি নিজের সন্তানের শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। বালক চাণক্য সম্পূর্ণ বেদ অর্থসহ মুখস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত তক্ষশীলাতে শুরু হয় চাণক্যের পড়ালেখা।
শৈশব থেকেই চতুর বালক চাণক্য রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির অধ্যয়ন বেশ উপভোগ করতেন। কৈশোরে পদার্পণ করেই অর্থনীতি নিয়ে লেগে গেলেন। একে একে সাহিত্য, যুদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানও অধ্যয়ন করেন চাণক্য। তার রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে অনেকে তাকে অসৎ মানুষ বলে আখ্যায়িত করেন । তবে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি আদর্শ ভারতীয় ভাবধারায় জীবন ধারণের পন্থা আলোচনা করেন।

তক্ষশীলা
সম্ভ্রান্ত এবং রাজবংশীয় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকতো তক্ষশীলা ।সেখানকার শিক্ষকগণও ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। রাজা রাজড়াদের সন্তানদের সাথে একত্রে পড়ালেখা করে চাণক্যের মাঝেও বেশ শৌখিন মনোভাব সৃষ্টি হয়। তথাপি, শিক্ষা-দীক্ষা সম্পন্ন করে তিনি সঠিক পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। শিক্ষকতাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন চাণক্য।
দীর্ঘদিন একসাথে জ্ঞানচর্চা করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চাণক্য দুজনের মধ্যে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে নীতিশাস্ত্র শেখানোর পাশাপাশি একজন দক্ষ যোদ্ধারূপে গড়ে তোলেন। মহাবীর আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার সময় চাণক্য আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর রণকৌশল গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য র উপদেষ্টা হিসেবে যুদ্ধের ছক কশতে এবং নীতি ঠিক করে দেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত ও তার বাহিনীকে যদি ধরা হয় একটি মানবদেহ, চাণক্য ছিলেন তার মস্তিস্ক। সরাসরি গ্রিকদের বিতাড়ন করা সম্ভব নয় জেনে চাণক্য একজন একজন করে আলেকজান্ডারের নিয়োগ করা ‘সার্ত্রাপ’ বা প্রাদেশিক শাসক হত্যা করার পরামর্শ দেন। সেই অনুযায়ী কাজ করেই চন্দ্রগুপ্ত সফলতা পান। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ২ বছরের মধ্যেতো গ্রিকরা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসনের আশাই ছেড়ে দেয়।
চাণক্যের প্রখর বুদ্ধিতে এই সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে করতে পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

মৌর্য সম্রাজ্য
চাণক্যের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ । ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ অনেক আলোচনা এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক দুই হাজার বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও। এই বইটিকে একটি বিশ্বকোষ বলা হয়।
চাণক্যের দর্শনের কিছু মূল বিষয় –
১) বিষ না থাকলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে
বিষহীন সাপকে যে কেউ ঘায়েল করে ফেলবে। তাই নিজেকে রক্ষার জন্য হলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে। অন্যকথায়, শত্রুর নিকট নিজের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করা যাবে না।
২) জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো
সে সময় রাজতন্ত্র চালু ছিল এবং রাজ দরবারেও কেবল সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোকেরাই কাজ পেত। চাণক্য মনে করতেন রাজতন্ত্র চলতে পারে, কিন্তু রাজ দরবারে রাজার মন্ত্রী উপদেষ্টা হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশের পরিচয়ে নয়।
৩) পুরোপুরি সৎ হওয়া যাবে না
“সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা” নয়! অন্তত সবসময় নয়, এমনটিই ছিল চাণক্যের বিশ্বাস। বেশিমাত্রায় সৎ এবং সরল হলে মানুষ আপনাকে ব্যবহার করবে, আপনার দুর্বলতার সুযোগ নেবে। তার কাছে সততা নয়, বরং লৌকিকতাই সর্বোৎকৃষ্ট।
৪) যেকোনো কাজের পূর্বে তিনটি প্রশ্ন
আমি কেন এ কাজটি করবো? এর সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে? আমি কি আদতে সফল হবো? যেকোনো কাজের পূর্বে নিজেকে এই ৩টি প্রশ্ন করার উপদেশ দিয়েছেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য পরিচালনায়ও তিনি সর্বদা এই নীতি অনুসরণ করেছেন।
৫) ভীতি গ্রাস করার পূর্বেই একে ধ্বংস করে দাও
চাণক্যের একটি চমৎকার ভাবনা হচ্ছে ভীতি এবং সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান। যখন আপনি নিশ্চিত যে শীঘ্রই কোনো সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন, তখন সেটি শুরু হবার আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যে ব্যাপারটি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন, নিজে ভীত হবার পূর্বেই সে ব্যাপারটি মিটিয়ে ফেলুন। এটাই চাণক্যর উপদেশ।
৬) একটি চাকা এককভাবে চলতে পারে না
চাণক্যের রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দর্শনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবনা এটি। তিনি একটি সরকারকে একটি দ্বিচক্রযানের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে রাজা একটি চাকা এবং তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা অপর চাকা। যোগ্য ও বুদ্ধিমান উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীপরিষদ ছাড়া রাজা অচল। আবার যথার্থ নেতৃত্বগুণ বিশিষ্ট রাজা ছাড়া মন্ত্রীপরিষদও কোনো কাজ করতে পারবে না।
৭) ফলাফলই শেষ কথা।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চাণক্য যেসব নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো মোটেও নৈতিকতার ধার ধারে না। বরং কার্যকর ফলাফল আনয়নের জন্য যত প্রকার ছল-চাতুরী প্রয়োজন, সবই করতে হবে বলে মনে করতেন চাণক্য। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ শিবিরে গুপ্তচর পাঠানো, ঘুষ দিয়ে উচ্চপদস্থ সেনাসদস্যদের হাত করে নেয়া, মধ্যস্থতার কথা বলে ঝোপ বুঝে কোপ দেয়া, শত্রুর শত্রুদের সাথে জোট বাঁধা সহ যা করা প্রয়োজন সবকিছুর পক্ষেই মত দিতেন চাণক্য। এসবের বিনিময়ে ফলাফল নিজের প্রজাদের পক্ষে রাখা চাই, এটিই তার মত।
৮) অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নাও
তার মতে প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কিছু নির্দিষ্ট ভুল করবেই। তবে কেবল নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধরে যাবার আশা করলে, তা হবে দুরাশা। কারণ মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকবে না। বরং নিজের ভুলের সাথে সাথে অন্যদের ভুলগুলোতে নজর রাখতে হবে, সেখান থেকে শিখে নিতে হবে করণীয়।

পাটালিপুত্র
২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেন। কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তা নিয়ে আছে মতপার্থক্য।
Summary
চাণক্য নীতি- যার উপদেশে চলত চন্দ্র গুপ্তের রাজ্য